০৬ মার্চ,২০২৩ বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব ও অর্থনৈতিক সঙ্কট
স্ট্র্যাটেজিক কারণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাংলাদেশের গুরুত্ব অপরিসীম। দেশটির তিন দিক ভারত এবং একদিকে মিয়ানমার দিয়ে বেষ্টিত। দক্ষিণে উন্মুক্ত বঙ্গোপসাগর। চীন বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী। বাংলাদেশ থেকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রায় ৩০০ কোটি মানুষের রাজনীতি, অর্থনীতি ও ব্যবসায়-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ রয়েছে। তাই ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত।
প্রথমত ভারতের পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্য বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটান রাষ্ট্রের স্থলভাগ দিয়ে বেষ্টিত; কেবল সরু একটি করিডোর দিয়ে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সাথে যোগাযোগ রয়েছে, যা অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। ফলে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে এ সাতটি রাজ্যের সাথে ট্রানজিটের চেষ্টা করছে ভারত অথচ ট্রানজিটের অবকাঠামো ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ের তুলনায় সংশ্লিষ্ট মাশুল দিচ্ছে খুবই কম। অন্য দিকে, ভারতের ওই সাতটি রাজ্যের মধ্যে চারটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ খ্রিষ্টান; যাদের স্বাধীন হওয়ার চাপ রয়েছে, যাতে পশ্চিমা ক্ষমতাধর খ্রিষ্টান রাষ্ট্রের সহযোগিতা থাকা অস্বাভাবিক নয়। এই চাপের একটি প্রভাব বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলেও রয়েছে। ব্রিটিশদের থেকে উপমহাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর হায়দরাবাদ ও সিকিমকে ভারত অধিভুক্ত করে। বাংলাদেশের জনগণের মধ্যেও এমন একটি ভীতি রয়েছে।
মিয়ানমারের ১৪টি প্রদেশের মধ্যে কেবল আরাকানেই ৭০ লাখ মুসলমানের অর্ধেকের বেশির অধিবাস। ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে আরাকান স্বাধীন রাজ্য হিসেবে হিন্দু, মুসলিম ও বৌদ্ধ শাসকদের হাতে শাসিত হয়েছে। বাংলাদেশের বর্ডারে অবস্থিত এই আরাকান রাজ্যকে মুসলিম মুক্ত করার জন্য রয়েছে বিভিন্ন পরাশক্তির চাপ, যা বাংলাদেশকেও বিপদে ফেলছে।
মিয়ানমারের এ রাজ্যে চীন গভীর সমুদ্রবন্দরসহ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ছে যা বঙ্গোপসাগরের কূলে কায়োকফু বন্দর থেকে রাখাইন রাজ্যের মধ্য দিয়ে চীনের তৈরি পাইপলাইন কুনমিং অবধি পৌঁছাচ্ছে যার দ্বারা মধ্যপ্রাচ্য থেকে বঙ্গোপসাগর হয়ে তেল ও গ্যাস পরিবহন করেছে। এ ছাড়াও রাখাইন উপকূলের গ্যাসক্ষেত্র থেকে মিয়ানমার প্রতিদিন ৩৭৯ মিলিয়ন কিউবিক ফুট গ্যাস চীনে রফতানি করে। এই কায়োকফু অর্থনৈতিক অঞ্চল বাস্তবায়নের জন্যই রোহিঙ্গাদের বিতাড়ন করে। সব মিলিয়ে চীন এই অঞ্চলের বিষয় নিয়ে খুব সতর্ক ও শক্ত অবস্থানে থাকবে, এটিই স্বাভাবিক।
অন্য দিকে, ভারতের সহায়তায় রাখাইনে কালাদান বহুমুখী ট্রানজিট-ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট করছে যা ভারতের পূর্বাঞ্চলের সাত রাজ্যকে রাখাইনের মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগরের সাথে সংযুক্ত করছে। রাখাইন রাজ্যে চীন ও ভারতের বিনিয়োগের মূল লক্ষ্য হলো, মালাক্কা প্রণালির ব্যবহার ব্যতিরেকে বঙ্গোপসাগরের সাথে রাখাইনের মাধ্যমে যুক্ত করা, তাতে পণ্য পরিবহন ব্যয় ও দূরত্ব কমে যাবে। এ জন্যই বাংলাদেশের সাথে এত সুসম্পর্ক বিদ্যমান থাকা সত্ত্বে¡ও চীন ও ভারত রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গাদের বিতাড়নের সময় সমগ্র বিশ্ব নিন্দা করলেও এই দুই দেশ সমর্থন করে।
বিশ্বরাজনীতিতে যে দেশ মার্কিনিদের সমকক্ষ কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বী হয় তাদের ঘিরেই মার্কিন নীতি ও কৌশল। সে মাফিক এখন চীনকে ঘিরেই যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের রাজনৈতিক মেরুকরণ হচ্ছে। রাখাইনে চীনের গভীর সমুদ্রবন্দরসহ অপরাপর উন্নয়নমূলক কাজ পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হলে সেখানে চীনের নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে। এ আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে বিশ্বের পরাশক্তি বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের প্রবেশাধিকার বিঘ্নিত হবে। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই চীনের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো এখন মার্কিন নীতির টার্গেট। এ জন্য তারা ভারতকে নিয়ে চীনকে মোকাবেলা করে যাচ্ছিল; হালে অবশ্য বাতাস ভিন্ন দিকে বইতে শুরু করছে। এ বিষয়টিকে বিবেচনায় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গোপসাগরে তার প্রবেশাধিকার ও আধিপত্য অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য বাংলাদেশের সাথে অর্থনৈতিক ও সামরিক সহযোগিতার বৃদ্ধিতে বদ্ধপরিকর। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো বাংলাদেশকে আকর্ষণীয় বিনিয়োগ প্রস্তাব দিয়েছে। এ ছাড়াও ভূ-রাজনীতির বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী এক দশকেই বিশ্বের নেতৃত্ব চলে আসবে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ায়। সুতরাং বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থা আরো শক্তিশালী হবে।
পরাশক্তির দেশের সাথে বাংলাদেশের অসম বাণিজ্য চীন ও ভারত উভয়ের সাথেই বাংলাদেশের পাহাড়সম বাণিজ্যিক বৈষম্য রয়েছে। ভারত তার পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় ব্যবসায়-বাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছে। অথচ ভারত গঙ্গা, তিস্তাসহ অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা বাংলাদেশকে আজো দেয়নি। বলতে গেলে, ভারত বাংলাদেশ থেকে শুধু নিয়েছে, তেমন কিছু দেয়নি; বরং দেশের বিপদের সময় বুক নয়, পিঠ দেখিয়েছে। ভারত থেকে ন্যায্য সুবিধা আদায়ে শক্তিশালী সরকারের উপস্থিতি বাংলাদেশের জন্য অপরিহার্য। তা ছাড়া বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য চট্টগ্রাম-কুনমিং রেল ও সড়ক যোগাযোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই যোগাযোগ ব্যবস্থার সূত্র ধরে বাংলাদেশের উৎপাদিত তৈরী পোশাকসহ বিভিন্ন বিশ্বমানের পণ্য ৩০০ কোটি মানুষের কাছে পৌঁছে যেতে পারে। চীন ও ভারতের সাথে রয়েছে মিয়ানমারের বিশাল সীমান্ত; রয়েছে বাংলাদেশেরও। সুতরাং মিয়ানমার অশান্ত হলে বাংলাদেশে তার প্রভাব পড়বেই। মিয়ানমারে চলছে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ। বিতাড়িত হচ্ছে আরাকানি মুসলমান; আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে। আরো আসার অপেক্ষায়। এরা দেশকে অশান্ত করে ফেলেছে।
রাশিয়া তার শীতলযুদ্ধপূর্ব হৃত শক্তি ফিরে পাচ্ছে প্রেসিডেন্ট পুতিনের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে। ইউক্রেন যুদ্ধে গত এক বছর ধরে পুরো পশ্চিমা বিশ্বের সাথে একাই লড়ছে রাশিয়া। বাংলাদেশের রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের পুরো বিনিয়োগ রয়েছে রাশিয়ার। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বলিষ্ঠ সমর্থন দেয়া রাশিয়ার প্রতি বাংলাদেশ কৃতজ্ঞ। রাশিয়া থেকে বাংলাদেশ আমদানি করছে গম, সার ও জ্বালানি; অন্যদিকে রফতানি করছে পোশাক।
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গার্মেন্ট পণ্যের সবচেয়ে বড় ক্রেতা; সাথে রয়েছে তার ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত বন্ধুরাষ্ট্রগুলো। তা ছাড়া বাংলাদেশে রয়েছে আমেরিকার সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ। বাংলাদেশের জনগণ অভিবাসন, উচ্চশিক্ষা, ব্যবসা ইত্যাদি বিভিন্নভাবে আমেরিকার ওপর নির্ভরশীল। সর্বোপরি আন্তর্জাতিক প্রায় সব সংস্থা আমেরিকার অনুসারী; সুতরাং এই পরাশক্তির কথা বাংলাদেশকে ভাবতেই হবে।
ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের চাপ আগামী বিশ্ব রাজনীতি এখন ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল ঘিরে। কারণ চীনের উত্থান, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-কৌশলগত গুরুত্ব, এই অঞ্চলের দেশগুলো বিশ্ব অর্থনীতিতে উদীয়মান শক্তি ও আসিয়ানভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর সক্ষমতা, আঞ্চলিক সহযোগিতা ও ভারসাম্য ইত্যাদি। অধিকন্তু, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদ ও বাণিজ্যিক পথও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। যুক্তরাষ্ট্রের এশিয়া-প্যাসিফিক নিরাপত্তার ধারা প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলো থেকে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে পরিণত হচ্ছে। ভারত মহাসাগরও এর সাথে যুক্ত হয়ে পড়ছে। ইন্দো-প্যাসিফিক গুরুত্ব বাড়ার সাথে ‘বে অব বেঙ্গলের’ গুরুত্ব বাড়ছে। আর ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ ‘বে অব বেঙ্গলের’ সাথে যুক্ত। বঙ্গোপসাগরের গুরুত্ব বাড়ার অন্যতম কারণ; দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগের মাধ্যম বঙ্গোপসাগর; চীনের অন্যতম বাণিজ্যিক পথ মালাক্কা প্রণালিতে মার্কিন ও তার মিত্রদের শক্ত অবস্থানের জন্য চীন বঙ্গোপসাগরের দিকে নজর দেয়, সে হিসেবে বঙ্গোপসাগরে মার্কিন অবস্থান থাকা; চীন বাংলাদেশের প্রতিবেশী হওয়ায় এখানে মার্কিন উপস্থিতি চীনের কামনা না করা; ভারতের সাম্প্রতিক পররাষ্ট্রনীতি মার্কিন প্রশাসনের বাইরে চলে যাওয়া; ভারতের সাত রাজ্যের সাথে বাণিজ্য সহজ করার প্রচেষ্টা; চীনের বেল্ট রোড অ্যান্ড ইনিশিয়েটিভ পরিকল্পনার অংশ বাংলাদেশ হওয়া ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। তাই ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর দৃষ্টি বাংলাদেশের দিকে নিবদ্ধ।
চীন কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের লক্ষ্য তাদের স্বার্থ উদ্ধার। বাংলাদেশের কাছে উভয় রাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে আমদানির দিক থেকে চীন, রফতানির দিক থেকে মার্কিন ও তার মিত্র ইউরোপ। সে হিসাবে বাংলাদেশকে পশ্চিমা ও চীন নির্ভরশীলতা হ্রাস করে অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক বাড়াতে হবে। বাংলাদেশ চীনের বিশেষ অর্থনৈতিক কর্মসূচির সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে। এখানেও সাবধানতার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, কারণ ইতোমধ্যেই চীনের ঋণফাঁদ নিয়ে নানামুখী কথা চালু আছে। এ ছাড়া চীনের সাথে বন্ধুত্ব মানে পশ্চিমাদের শত্রু, বিশেষ করে প্রতিবেশী ভারত অনেকটাই নেতিবাচক। তারপরও বাংলাদেশ সবার কাছে এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠায় সবাই সম্পর্কোন্নয়নে আগ্রহী।
আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিদেশনীতির কারণে বাংলাদেশ ও আমেরিকার মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল, ফলে সাউথ এশিয়ায় তাদের প্রভাব হ্রাস পায়। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধাবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্ট বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় পরিবেশ পরিবর্তিত হয়। সাম্প্রতিক সময়ের চতুরাষ্ট্রীয় জোট কোয়াড বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটির খারাপ দিক হচ্ছে- ভারত মহাসাগরে আমেরিকার নৌশক্তি বৃদ্ধি বা প্রভাব বিস্তার। এখানে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে বৈরিতা ও প্রতিযোগিতা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে ভারত এবং চীন তাদের অস্ত্র ব্যবসার ক্ষেত্রকে প্রসারিত করতে সচেষ্ট হবে মনে হয়। সে ক্ষেত্রেও মিয়ানমারের সাথে সীমান্ত সঙ্ঘাত ও রোহিঙ্গা সমস্যার বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। ভুল করলে মিয়ানমারকে কেন্দ্র করে এই অঞ্চলেও ইউক্রেনের মতো একটি প্রক্সিযুদ্ধ বেধে যেতে পারে, যার বলির পাঁঠা হতে পারে বাংলাদেশও।
চীন-ভারত দ্বন্দ্ব বাংলাদেশের জন্য উভয়ের থেকে অর্থনৈতিক সুবিধা আদায়ের সুযোগ। তবে এ ক্ষেত্রে চীনা ‘ঋণফাঁদ’ ও ভারতের ‘বড়ভাই’ সুলভ আচরণ বিবেচনায় রাখতে হবে। অন্য দিকে, মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা সমস্যাকেও ছোট করে দেখা যাবে না। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে মিয়ানমারের যেমন সদিচ্ছার অভাব, তেমনি জাতিসঙ্ঘ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর কোনো আন্তরিক উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গনে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। স্থানীয় জনগণও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছে, ফলে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্টসহ রাজনৈতিক ও সামাজিক বিরোধজনিত অশান্তি সৃষ্টির সম্ভাবনা সৃষ্টি করছে।
বিদেশী চাপে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা দেশের অর্থনীতি এখন চাপের মুখে। সরকার অর্থনৈতিক সঙ্কটের দায় কোভিড ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ওপর চাপাতে চায়। বিরোধীরা অবশ্য মনে করেন, লাগামছাড়া দুর্নীতি ও সরকারের ভুলনীতি পরিস্থিতিকে এতটা শোচনীয় করে তুলেছে। তবে গত কয়েক দশকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বাংলদেশ যথেষ্ট এগিয়েছে; যদিও রাজনীতি বিবেচনায় গত এক দশকে বাংলাদেশের অনেক খারাপ দিক সামনে চলে আসে। এই সময়ে দেশে দু-দুটি অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়েছে। গণতন্ত্রের মান নেমেছে। মানবাধিকার পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কমেছে এবং আচার-আচরণে সরকার কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠেছে। গুম-খুন, দুর্নীতি ও অর্থপাচার এতটাই বেড়েছে যে, জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। সরকার ও সরকারি দলের একান্ত অনুসারী ছাড়া বাকি সব জনগণ সরকারের বিপক্ষে চলে যাচ্ছে। ফলে সরকারের উন্নয়নও জনগণ ভালোভাবে নেয় না। দেশের অর্থনীতি ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি যাই হোক, আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের গুরুত্ব বাড়ছে। দুই পরাশক্তি, বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলের দেশগুলোকে তাদের পক্ষে রাখতে চায়। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বাংলাদেশের গুরুত্ব আরো বাড়িয়েছে। এই যুদ্ধে রাশিয়া-চীন চায় বাংলাদেশ নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকুক; অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা চায় ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার বিরোধিতা করুক। বাংলাদেশ কখনো এদিক, কখনো ওদিক করে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছে। সর্বশেষ, রাশিয়ার বিপক্ষে জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত থাকে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধকে উপেক্ষা করতে পারছে না বাংলাদেশ। আবার রাশিয়াকেও পারছে না দূরে ঠেলতে। ইউক্রেন সঙ্কট ঘিরে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার দূতাবাসের পাল্টাপাল্টি মন্তব্য ও তৎপরতা দেখা যাচ্ছে, যা আগে কখনো দেখা যায়নি। সর্বশেষ, রাশিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য পাঠানো পণ্য জাহাজ থেকে খালাস না করার জন্য কৈফিয়ত তলব তারই নমুনা।
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যেও একই অবস্থা। যখন তার ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল নিয়ে মাঠে নেমেছে, তখন থেকেই বাংলাদেশ দুই শিবিরের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করে আসছে। বাংলাদেশ চীনের বৈশ্বিক যোগাযোগ অবকাঠামো বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগে যুক্ত হয়েছে। অন্য দিকে যুক্তরাষ্ট্র কোয়াড, আইপিএস, জিএসও, এমআইএ বা এসিএসএর মতো নানা কৌশলগত ও সামরিক উদ্যোগে যোগ দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। বাংলাদেশ এসব নিয়ে হ্যাঁ বা না কিছুই বলেনি। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের তরফে চাপ ভবিষ্যতে বাড়বে বলেই মনে হয়। আবার এসব উদ্যেগে যোগ দিলে চীন যে বিরক্ত হবে, তা তারা স্পষ্ট করেই বিভিন্ন সময় বলেছে। বোঝা যায়, বর্তমান পরিস্থিতিতে দুই পক্ষের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার কাজটি বেশ জটিল হবে।
এক সময় দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের আধিপত্য মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্র অনেকটাই ভারতের ওপর নির্ভর করত। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের পরের বিশ্বরাজনীতিও অনেক হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিয়েছে। দুই চরম প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ ভারত ও চীনের অবস্থান রাশিয়ার পক্ষে ও যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে। বাংলাদেশও এই পরিবর্তনগুলোর প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পাশে থাকার কথা বলছে আমেরিকা; অন্যদিকে, চীন ও ভারতের অবস্থান পরিষ্কারভাবেই মিয়ানমারের পক্ষে। চীনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশকে নিজেদের দলে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব বাংলাদেশের রাজনীতিতে আসছে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতি। ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বের কারণে দেশের এই অভ্যন্তরীণ বিষয় এখন আন্তর্জাতিক ইস্যু হয়ে উঠেছে। সরকার অবশ্য চীনের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখছে, অন্যদিকে ভারতের সাথে রাজনৈতিক সম্পর্ক রক্ষা করছে। ফলে, গণতন্ত্র, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন, মানবাধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাসহ নানা ইস্যুতে বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ বাড়ছে। র্যাব ও এর কিছু কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং টানা দুই বছর গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ না জানানো তারই প্রমাণ। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উপদেষ্টা বাংলাদেশে এসে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, মানবাধিকার ও ভিন্নমতের প্রতি সহনশীলতার বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে গেলেন। এখন আবার বাংলাদেশের একমাত্র রফতানি পণ্য তৈরী পোশাকের নীতির দোহাই দিয়ে অবরোধ আরোপের সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে; ফলে গভীর সঙ্কটে দেশ।
সর্বোপরি বলতে হয়, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া ও ভারত এই চার পরাশক্তির সাথে সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষা করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। এমতাবস্থায়, দেশের ভূ-রাজনৈতিক সুবিধা কাজে লাগানোর জন্য প্রয়োজন একটি বলিষ্ঠ সরকার, যাতে সরকার, বিরোধীদল ও আপামর জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে ভূ-রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের জন্য দাম কষাকষি করতে পারে। অথচ উল্টো দেখা যাচ্ছে, সরকার ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য পরাশক্তির এক গ্রুপের সাথে দাম কষাকষি করছে। অন্য দিকে, বিরোধীদল ক্ষমতায় আসার জন্য অন্য গ্রুপের সাথে মিলে সরকার তথা দেশের ওপর বিভিন্ন অবরোধকে স্বাগত জানাচ্ছে। ফলে ভূ-রাজনৈতিক সুবিধা কাজে লাগিয়ে দেশ তো কিছু পাচ্ছেই না; বরং দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে কাজে লাগিয়ে বিদেশীরা উল্টো বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন সুবিধা নিতে চাচ্ছে। ভূ-রাজনীতি যদি দেশের রাজনীতির অন্যতম নিয়ামক হয়, জনগণ যদি সেখানে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে, তবে তা সত্যিই বিপদের কথা। এখন বাংলাদেশকে ভূ-রাজনৈতিক কারণে সৃষ্ট সুযোগগুলোকে কাজে লাগানোর পাশাপাশি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য সাউথ-এশিয়া ও এশিয়া-প্যাসিফিকসহ বিভিন্ন বৈশ্বিক কূটকৌশলকে খুব ধীরগতিতে সুসম্পন্ন করে সুবিধা নিতে হবে; অন্যথায় দেশের সম্ভাবনা সমস্যায় পরিণত হবে।