এই ভাষণই প্রমাণ করে সু চি রক্তপিপাসু ও গণহত্যায় জড়িত
২০ সেপ্টেম্বর,২০১৭ ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান
মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বার্মিজ আর্মি ও ‘চরমপন্থী বৌদ্ধ ডেথস্কোয়াড’ বাহিনীর রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর চালানো গণহত্যা ও বর্বর নির্যাতনের ঘটনায় তিন সপ্তাহেরও বেশি নীরব থাকার পর মঙ্গলবার রোহিঙ্গা ইস্যুতে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছেন অং সান সু চি।
৩০ মিনিটের ভাষণে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি ব্যবহার না করে সু চি বলেছেন, ‘রাখাইন সংঘাতের শিকার সব মানুষের দুর্ভোগ তারা গভীরভাবে অনুভব করেন। মুসলিমরা কেন চলে যাচ্ছে সেটি খুঁজে বের করার জন্য তিনি তাদের সাথে কথা বলতে চান। এছাড়া রাখাইনে সহিংসতার জন্য দায়ীদের আইনের আওতায় আনা এবং রাখাইনে শান্তি ফেরানো হবে।’
রোহিঙ্গাদের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি আরো বলেন, ‘রাখাইনে সন্ত্রাসীরা পুলিশের উপর হামলা চালিয়েছে। মায়ানমার সেনাবাহিনী শান্তিরক্ষায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। ফলে রাখাইনে শান্তি ফিরে না আসা পর্যন্ত সেখানে সেনা অভিযান চলবে। তিনি বিশ্ববাসীকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অনেকটাই ঔদ্ধত্যের সুরে এও বলেছেন, ‘রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পর্যবেক্ষণ মায়ানমার ভয় পায় না।’
তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘বিশ্ব নেতারা মায়ানমারে আসুন, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করুন, দেখুন কেন মুসলিমরা পালাচ্ছে।’ এছাড়াও সহিংসতার মুখে পালিয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের প্রত্যাবাসনে যাচাই-প্রক্রিয়া শুরু করতে মায়ানমার প্রস্তুত বলেও উল্লেখ করেছেন সু চি।
তবে সু চির এ ধরনের ভাষণে আশ্বস্ত হতে পারছে না আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো। তারা বলছে, সু চি তার ভাষণে সেনাবাহিনীর ভূমিকার বিষয়ে কিছু বলেননি। তিনি তার বক্তব্যে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে আক্রান্ত লোকজনকে দোষারোপ করেছেন।(এএফপি)
মায়ানমারের মানবাধিকার বিষয়ে জাতিসংঘের তথ্য অনুসন্ধান মিশনের প্রধান মারজুকি দারুসমান বলেছেন, রাখাইনে যেসব সহিংসতার অভিযোগ পাওয়া গেছে, তা খতিয়ে দেখতে হলে ঘটনাস্থলে যেতে হবে। আর এর জন্য প্রয়োজন দেশটিতে পূর্ণভাবে অবাধে প্রবেশের নিশ্চয়তা। এই সংকটের বিষয়ে দ্রুতই দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।
মায়ানমারের রাখাইনে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ওঠা সহিংসতার অভিযোগের বিষয়ে কিছু না বলায় অং সান সু চি ও তার সরকারের কড়া সমালোচনা করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। সংস্থাটি বলছে, আজকের ভাষণে সু চি স্পষ্ট করেছেন যে তিনি ও তার সরকার রাখাইনের সহিংসতা বিষয়ে বালুতে মাথা গুঁজে রেখেছেন। তিনি বরং তার বক্তব্যে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন। যারা আক্রান্ত হয়েছে, তাদেরই দোষারোপ করেছেন।
সু চি পরিস্থিতি দেখতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে যে আহ্বান জানিয়েছেন, সে ব্যাপারে সংস্থাটি বলছে, মায়ানমারের যদি কিছু লুকানোর না থাকে, তাহলে জাতিসংঘের তথ্য অনুসন্ধান কমিটিকে তদন্তের জন্য দেশটিতে ঢুকতে দেওয়া হোক।
প্রসঙ্গত গত তিন সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে চলা সেনা অভিযানে এক হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত এবং দমন-পীড়নের মুখে চার লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। কোনো কোনো সংস্থার মতে সেখানে ৫ থেকে ১০ হাজার লোককে হত্যা করা হয়েছে। এর বেশির ভাগই মুসিলম রোহিঙ্গা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অনেকেই এ বিষয়ে মায়ানমার ও সু চির ভূমিকার সমালোচনা করে আসছেন।
উপরোল্লেখিত সু চির বক্তব্য ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার বক্তব্যে এটা প্রমাণ হয় যে-
এক. সু চি তার ভাষণে রাখাইনের সত্যকে আড়াল করে যেভাবে কথা বলেছেন তাতে সেনাবাহিনীর চলমান গণহত্যাকেই উৎসাহিত করা হয়েছে। কেননা, তার ভাষণে দু’দিন আগে দেওয়া কসাই সেনাপ্রধানের বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি হয়েছে। এর মাধ্যমে তিনি বিশ্ববাসী ও মানবাধিকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পুরো বিশ্বকে হতবাক ও স্তম্ভিত করেছেন।
দুই. ভাষণে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি ব্যবহার না করে সু চি রাখাইনে মুসলিম রোহিঙ্গাদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে মূলত তার পিতাকে অং সানকে অস্বীকার করে নিজেকে জারজ সন্তানে রূপ দিয়েছেন। কেননা, জেনারেল মিন অং হ্লাইয়াং এবং সু চি—উভয়েই জাতিঘৃণার প্রকাশ ঘটাতে গিয়ে কার্যত বার্মার রাজনৈতিক ইতিহাসকেই অস্বীকার করছেন। সু চির বাবা জেনারেল অং সানের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক সহযোগী ছিলেন একজন মুসলমান আবদুল রাজ্জাক। এছাড়াও ছাত্রজীবনে রেঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সময় ছাত্ররাজনীতিতে অং সানের পরম বন্ধু ছিলেন দুই মুসলিম রাশিদ এবং উ নু। তারা একসঙ্গে রাজনীতি করেছেন।
১৯৪৭ সালে বার্মার সংবিধানের অন্যতম খসড়াকারীও ছিলেন রাশিদ। পরবর্তীকালে তিনি দেশটির শ্রমমন্ত্রীও হন। অং সান-রশিদ-উ নু-রাজ্জাক প্রমুখের বন্ধুত্ব স্বাধীনতার উষালগ্নে বার্মায় ‘বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্যে’র যে সম্ভাবনা তৈরি করেছিল, তার ভিত্তিতেই ১৯৪৭-এর ফেব্রুয়ারিতে শান স্টেইটের পাংলংয়ে ঐতিহাসিক জাতি-সম্মেলন আহূত হয়েছিল এবং সেখানে অং সান বলেছিলেন, বার্মা হবে সব জাতির একটি ‘ইউনিয়ন’, যেখানে ‘বর্মনরা এক কায়েত পেলে অন্যরাও এক কায়েত পাবে।’ আর এই ঐতিহাসিক প্রতিশ্রুতির ওপর দাঁড়িয়েই কাচিন-কারেন-শান-মুসলমান সবাই বর্মা ইউনিয়নে যোগ দিয়েছিল সেদিন।
অথচ আজ সেই অং সানের কন্যা বার্মাতে মুসলমান রোহিঙ্গাদের অস্তিত্বই অস্বীকার করছেন। সেনাবাহিনীও বলছে, রোহিঙ্গা বলে বর্মায় কোনো বৈধ জাতিসত্তাই নেই এবং ছিলও না।
বার্মা সরকার এবং সে দেশের সেনাবাহিনী বর্তমানে বেশ জোরেশোরেই বলে থাকে, আরাকানের রোহিঙ্গারা সে দেশের নাগরিক নয়, বাংলাদেশ থেকে যাওয়া মানুষ। এই দাবি যে কত স্ববিরোধী, তা বহুভাবেই প্রমাণযোগ্য।( প্রথম আলো, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭)
তিন. আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়ে সু চি বলেছেন, ‘বিশ্ব নেতারা মায়ানমারে আসুন, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করুন, দেখুন কেন মুসলিমরা পালাচ্ছে।’তার এই আহ্বান একেবারেই স্ববিরোধী। কেননা, রাখাইন প্রদেশের চলমান নির্যাতন নিয়ে উদ্বেগের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে মায়ানমারে এক দূত পাঠায় যুক্তরাষ্ট্র। ওই মার্কিন দূত হচ্ছেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের ডেপুটি সহকারী সচিব প্যাট্রিক মার্ফি মায়ানমারের সরকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও রাখাইন রাজ্য পরিদর্শন করেন। তবে রাখাইনের যেখানে সংঘর্ষ বিদ্যমান সেখানে যেতে দেওয়া হয়নি তাকে। এছাড়া আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা,দাতা সংস্থা, ও গণমাধ্যম কর্মীদের ওই এলাকায় প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। ফলে তার এ বক্তব্য চরম মিথ্যাচারিতা ছাড়া আর কিছুই নয় বলে আমরা মনে করি।
চার. সহিংসতার মুখে পালিয়ে আসা ব্যক্তিদের প্রত্যাবাসনে যাচাই-প্রক্রিয়া শুরু করার কথা বলেছেন সু চি। কারো বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দিলে কী আর তার কাছে কোনো তথ্য প্রমাণ থাকে? নিশ্চয় না। আর গত তিন সপ্তাহে যে ৪ লাখেরও বেশি লোক শরণার্থী হয়েছে তা তো শুধু বাংলাদেশ কিংবা রোহিঙ্গাদের কথা নয়। জাতিসংঘ নিজেই এ তথ্য দিয়েছে। ফলে প্রত্যাবাসনে যাচাই-প্রক্রিয়া শুরুর কথা বলে সুচি মূলত রোহিঙ্গাদের নিয়ে তামাসার নতুন ছক আঁকার চেষ্টা করছেন।
পাঁচ. ‘রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পর্যবেক্ষণ মায়ানমার ভয় পায় না।’ এ কথা বলে সু চি মূলত বিশ্ববাসীকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে প্রচ্ছন্নভাবে হুমকি দিয়েছেন। আর সেনা অভিযান অব্যাহত রাখার কথা বলে কার্যত রাখাইনে গণহত্যাকে আরো প্রলম্বিত করে রোহিঙ্গাদের সমূলে উচ্ছেদের ইঙ্গিত দিয়েছেন। যা খুবই অনাকাঙ্খিত ও দুঃখজনক।
তার এসব বক্তব্যই প্রমাণ করে শুধু বার্মিজ সেনাবাহিনীই এই হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে না। এতে সু চিরও পুরো সমর্থন রয়েছে। অন্যথা, বিশ্বে যখন রাখাইনের গণহত্যা নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় চলছে সেখানে তিনি তিন সপ্তাহেরও বেশি সময় নীরব ছিলেন কেন? রাষ্ট্রের শীর্ষ ক্ষমতাধর ব্যক্তি হয়েও কেন কোনো ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারলেন না?
আজ মায়ানমারের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা সম্প্রদায় অবর্ণনীয় ব্যাপক সহিংসতার মোকাবেলা করছে। তাদের ওপর চালানো হচ্ছে পাশবিক নির্যাতন আর বীভৎস হত্যাযজ্ঞ। বার্মার সামরিক বাহিনীর সহায়তায় চরমপন্থী বৌদ্ধদের ডেথস্কোয়াড রাখাইন রাজ্যকে নরকে পরিণত করেছে। রাখাইনে আজ বিভীষিকাময় অবস্থা। গত তিনসপ্তাহে রাষ্ট্রীয় বাহিনী আর বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর চালানো ‘গণহত্যায়’ আরাকানের সর্বত্র লাশ আর লাশ,পথে প্রান্থরে মুসলিম রোহিঙ্গাদের রক্তের বন্যা, আগুনে পোড়া লাশের দুর্গন্ধে আরাকানের বাতাস দুর্গন্ধময় হয়ে উঠেছে। এসব কিছু গোপন করতেই সু চির সরকারের বাহিনী সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, সমাজকর্মীসহ আন্তর্জাতিক মহলের সদস্যদের সেখানে প্রবেশে বাধা দিচ্ছে। এতে সহজেই অনুমেয় সেখানকার পরিস্থিতি কতটা বিভীষিকাময়।
এই অত্যাচারের ধরন বিস্ময়কর এবং এই বিষয়ে সুচির উদাসীনতা এবং আপেক্ষিক নীরবতা সত্যিকার অর্থেই ঘৃণ্য। ফলে আজকের ভাষণের পর বিশ্ববাসীর বুঝতে আর বাকী নেই যে অং সান সু চি কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক নেত্রী নন, বরং তিনি একজন রক্ত পিপাসু চরম বৌদ্ধত্ববাদী সাম্প্রদায়িক নেত্রী। তার নোবেল পুরস্কারে এবং যারা তাকে এই পুরস্কারে ভূষিত করেছে তাদের প্রতিও ধিক্কার। বিশ্বের হে মজলুম জনতা এক হও, যে কোনো মূল্যে রোহিঙ্গাদের জন্য আরাকানকে স্বাধীন করে দিতে হবে। অন্যথা, রক্তপিপাসু সু চির ঔদ্ধত্যের কাছে বিশ্ব মানবতা পরাজিত হবে।
তাই জাতিসংঘসহ বিশ্ব নেতাদের উদ্দেশ্যে বলবো- মানবাধিকার প্রশ্নে আপনারা নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করুন। মুসলিম তথা জাতিগত বিদ্বেষী না হয়ে আরাকানের স্বাধীনতা সংগ্রামে রোহিঙ্গাদের সমর্থন দিন। ত্রাণ নয়, তাদের স্বাধীনতাই এখন বড় প্রয়োজন। তাই জাতিসংঘ কর্তৃক অবিলম্বে রোহিঙ্গাদের জন্য আরাকানকে পৃথক রাষ্ট্র ঘোষণা করা হোক। বাংলাদেশের হর্তাকর্তাদেরও বলবো- নিপীড়িত রোহিঙ্গা মুসলিমরা আমাদের জন্য অভিশাপ নয়, আশীর্বাদ। ফলে একটি মজলুম জাতিকে স্বাধীন করে দেওয়া এবং তাদের বদৌলতে বাংলাদেশকে বহির্বিশ্বে তুলে ধরার এটাই অপূর্ব সুযোগ। আসুন, সকল ভেদাভেদ ভুলে স্বার্থের নোংরা রাজনীতি বাদ দিয়ে এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে রোহিঙ্গা মুসলিমদের জন্য স্বাধীন আরাকান প্রতিষ্ঠায় আমরা সবাই যথাযথ ভূমিকা পালন করি। হে আল্লাহ, হাজারো মুসলিম ভাই-বোনের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন আরাকান প্রতিষ্ঠার বাসনা কবুল কর। আমিন।