করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনাভ্যাস। আমাদের চারপাশে এক অদ্ভূত অনিশ্চয়তা ভর করে বসেছে। খাদ্যের অনিশ্চয়তা, চাকরি থাকা না থাকার অনিশ্চয়তা, সন্তানের পড়ালেখার অনিশ্চয়তা, চিকিৎসার অনিশ্চয়তা, করোনায় মৃত্যু হলে দাফন-কাফনের অনিশ্চয়তা। দেশে দেশে মানুষ চাকরি হারাচ্ছে। কর্মহীন হয়ে পড়ছে শ্রমিক। কলকারখানায় থেমে গেছে উৎপাদনের চাকা। এদিকে এপ্রিল মাসের রপ্তানি আয় দেশের ইতিহাসে সর্বনিম্ন। সরকারের রাজস্ব আদায় হ্রাস পেলেও বৃদ্ধি পেয়েছে রাজস্ব ব্যয়। ব্যয় মেটাতে সরকারের ঘাড়ে বাড়ছে ঋণের চাপ। দেশে দেশে খাদ্য সংকটের সম্ভাবনা প্রকট হচ্ছে।
এমন এক অনিশ্চিত বিশ্বে শিক্ষাক্ষেত্রেও দেখা দিয়েছে স্থবিরতা। বিজনেস ইনসাইডারের তথ্যানুযায়ী, বিশ্বের প্রায় ১৮৮টি দেশের শিক্ষার্থীরা করোনাকালে সরাসরি ক্ষতির সস্মুখীন হয়েছে। বাধাগ্রস্ত হয়েছে তাদের শিক্ষাকাল। স্কুল -কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ। শিক্ষার্থীরা ঘরবন্দি। অবশ্য কিছু কিছু দেশ পরিস্থিতি ভেদে স্কুল-কলেজ খুলে দিতে শুরু করেছে। তবে তা খুবই সীমিত আকারে। বাংলাদেশে প্রায় দুই মাসেরও অধিক সময় ধরে দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। কবে আবার শিক্ষা কার্যক্রমকে স্বাভাবিক করা যাবে সেটাও অনিশ্চিত। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় মাধ্যমিক পর্যায়ে সংসদ টিভির মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করেছে।
মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষার্থীদের জন্যও একইভাবে চালু করা হয়েছে টিভিতে সীমিত আকারে পাঠদান। যদিও ক্লাসের গুণগতমাণ ও তার কার্যকারিতা নিয়ে দেশের ভেতরে বিভিন্ন ধরনের আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ও টিভিতে প্রাথমিকের ক্লাস চালু করেছে। যদিও প্রান্তিক জনপদে টিভি না থাকারও অভিযোগ রয়েছে। আবার যাদের টিভি আছে তারাও মাঝে মাঝে বিদ্যুৎবিভ্রাটের কারণে সঠিকভাবে ক্লাসে যোগদান করতে পারছে না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি অনুমোদন নিয়ে ‘জুম’ অ্যাপস ও অন্যান্য ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে সীমিত আকারে তাদের পাঠ ও পঠন চালু করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। যদিও দেশের অধিকাংশ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার গুণগতমাণ নিয়ে কমবেশি সমালোচনা রয়েছে। তারপরও দেশে উচ্চশিক্ষা বিস্তারে তাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এ উদ্যোগ এখনও সেভাবে চোখে পড়েনি।
তবে দু-একটি বিশ্ববিদ্যায়লয় যে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম সীমিত আকারে শুরু করেনি তা কিন্তু নয়। তবে সে সংখ্যাটা খুবই সীমিত। কিছু শিক্ষক আবার স্ব-উদ্যোগী হয়েও জুম অ্যাপসের মাধ্যমে ক্লাস নিয়ে তার সচিত্র বিবরণ ফেসবুকে পোস্ট করে অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন। যা থেকে জানা যায় যে, ৩৫-৪০% শিক্ষার্থী পূর্বে ঘোষণা দেয়া সত্বেও ক্লাসে অনুপস্থিত থাকছে। কিন্তু কেন? সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরাই তার কারণ নির্ণয় করে বলছেন ছাত্রদের অসচ্ছলতার কারণে এমবি/নেট কিনতে না পারা বা কারও কারও তা আবার কেনার সামর্থ্য থাকলেও নেট ভয়াবহ রকমের স্লো, আবার আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে অ্যান্ড্রয়েড ফোন না থাকাটাও অন্যতম কারণ।
এ নিয়ে তো দেশের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও এক শিক্ষার্থীর তর্কযুদ্ধ দেশের এক জাতীয় পত্রিকার মাধ্যমে দেশবাসী অবগত হয়েছে। তা হলে এখন আমাদের করণীয় কী? কতদিনই বা আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হবে? কীভাবে এ ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া যাবে? তা নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। একদিন না একদিন আমাদের তো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। কারণ বর্তমান দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় অনলাইন ক্লাস পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে পুরোপুরি যে কার্যকরী হবে না তা ধরেই নেয়া যায়। কারণ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিকাংশ শিক্ষার্থী হয় মধ্যবিত্ত না হয় নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। সুতরাং তাদের পক্ষে এমবি/নেট ক্রয় করে নিয়মিত ক্লাসে অংশগ্রহণ সম্ভবপর নাও হতে পারে।
তবে স্বাস্থ্যবিধি পালন করে আমাদের কিন্ত একদিন না একদিন ক্লাসরুমে ফিরতেই হবে। সরকার ইতোমধ্যেই এ সংক্রান্ত বিধিবিধান প্রণয়ন করেছে। যা এখন নেট দুনিয়ায় ঘুরে বেরাচ্ছে আমরা যেটাই করতে যাই না কেন তার আগে করোনার বহুমাত্রিক রূপ ও তার ভয়াবহ প্রভাব মাথায় রেখেই করতে হবে। নিতে হবে সঠিক সিদ্ধান্ত। এবং তা বাস্তবায়নে ছক কষতে হবে নিখুঁতভাবে। এখানে কোনো প্রকার হটকারী সিদ্ধান্ত কাম্য নয়। তা না হলে শিক্ষাক্ষেত্রে ভয়াবহ বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।
প্রতিষ্ঠান খোলার আগে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাসরুমভিত্তিক আসনবিন্যাস, স্বাস্থ্য-সুরক্ষা সরঞ্জামাদির সহজ প্রাপ্যতা নিশ্চিত করেই তা করতে হবে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব কতটা নিশ্চিত করা যাবে তা কিন্তু ভাববার বিষয়। তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই। এতে হিতে বিপরীত ফলও হতে পারে।
এতদিন পর বলা হচ্ছে জীবন ও জীবিকা দুটোই পাশাপাশি চালাতে হবে। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে আমরা তো আজ এক ভয়াবহ রকমের স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছি। বলা হলো স্বাস্থ্যবিধি মেনেই শপিংমল ও দোকান খোলা হবে। কিন্তু খোলার পর দেখা গেল তা মানার কোনো বালাই নেই। যে জাতির কাছে জীবন নয় উৎসবই মুখ্য। সে জাতির কপালে যে দুঃখ আছে তা তো দিনদিন আরও প্রকট হচ্ছে। দেশে সাধারণ ছুটি, গণপরিবহন বন্ধ কিন্তু রাস্তায় মানুষের ঢল। আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। অপ্রতুল চিকিৎসাসেবা। এখন তো দেশে আর অন্যান্য রোগে অসুস্থ রোগীরও চিকিৎসা পাওয়া দুস্কর হয়ে পড়েছে।
যারা ভাবছেন যে ইউরোপ, আমেরিকা, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া অনলাইনে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে পারলে আমরা নয় কেন। তাদের বলছি আমরা যে তাদের মতো অনেক কিছুই পারি না এমনকি তারাও যেসব পারে না তা কিন্তু করোনা আমাদের দুই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। সুতরাং করোনার মতো এক কঠিন বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের সামর্থ্যের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যারা করোনার কারণে সেশনজট বৃদ্ধি পাবে বলে সরব হওয়ার চেষ্টা করছেন তাদের অনুরোধ করব অনুগ্রহ করে ৮০'র দশকের এরশাদ ভ্যাকেশনের কথা একবার ভেবে দেখুন। তখন শিক্ষাজীবন শেষ করতে প্রতিষ্ঠান ভেদে ৭/৮ বছর সময় লেগেছিল। আমরা কিন্তু সেখান থেকে পরিত্রাণ পেয়েছি। আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকরাই তা করতে সহযোগিতা করেছেন।
কিন্তু আজ যখন দেখি একজন শিক্ষক সময়মতো পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন না করার কারণে ফলাফল প্রকাশে বিলম্ব হচ্ছে, ক্লাস না নেয়ার কারণে সময়মতো সিলেবাস শেষ করতে পারেন না বলে রুটিন অনুযায়ী পরীক্ষা না নেয়ার কারণে সেশনজট বেড়ে যায় তখন কিন্তু তা জাতিকে হতাশ করে। যে কথা বলছিলাম, এরশাদ ভ্যাকেশনে কিন্তু ঘরে থাকাটা জরুরি ছিল না। আজ কিন্তু বাঁচার জন্য ঘরে থাকাটা খুবই জরুরি। করোনা থেকে মুক্ত থাকার জন্য সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাফেরা করাই কিন্তু একমাত্র উপায়।
এখনও করোনা ভ্যাকসিন নাগালের বাইরে। কবে তা পাওয়া যাবে তাও নিশ্চিত নয়। এমন এক জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গোটাবিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থা। বাংলাদেশের পরিস্থিতি আরও নাজুক। ইচ্ছে থাকলেও ভৌত ও প্রযুক্তিগত অবকাঠামোর অপ্রতুলতার কারণে হয়তো পুরোপুরি অনলাইন ক্লাস ও পরীক্ষায় যাওয়া এখনই সম্ভবপর হবে না। তাছাড়া ছাত্রছাত্রীদের আর্থিক অসচ্ছলতার বিষয়টাও না পারার অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচনার দাবি রাখে।
এমন এক জটিল পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয় কী সেটা সূচারুভাবে নির্ধারণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি করোনাকাল আরও দীর্ঘায়িত হয় তাহলে হয়তো আমাদের বাধ্য হয়েই অনলাইন ক্লাস ও পরীক্ষায় যেতে হবে। তবে সেক্ষেত্রে নিম্মোক্ত দুটি বিষয় বিবেচনা করে তা করা গেলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় তা করোনাকালের আশীর্বাদ বলেই বিবেচিত হবে।
এক.
প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের প্রযুক্তি ও ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন করে সময়োপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। যাতে করে অনলাইনে ক্লাস ও পরীক্ষা গ্রহণ করা সংশ্লিষ্ট সবার কাছে সহজসাধ্য হয়।
দুই.
অনলাইনে ক্লাস ও পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য শিক্ষার্থীদের বিনা পয়সায় ইন্টারনেট ব্যবহার করার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারদের সাথে এ সংক্রান্ত চুক্তি সম্পাদন করতে পারে। যারা একেবারেই অসচ্ছল তাদের প্রয়োজনমতে অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল সেট সরবরাহ করতে হবে।
আর যদি মনে হয় যে, করোনামুক্ত হয়ে আমরা আগামী দু-চার মাসের মধ্যেই ক্লাসরুমে ফিরে যেতে পারব- তাহলে তাড়াহুড়ো না করে অপেক্ষা করাই যুক্তিযুক্ত হবে। এক্ষেত্রে পরবর্তীতে ক্লাসের সংখ্যা বাড়িয়ে বা শীতকালীন ছুটি কমিয়ে করোনাকালের ক্ষতিটা সহজেই পুষিয়ে নেয়া যাবে। আমাদের দেশে শিক্ষিতের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু শিক্ষারগুণগত মান হয়েছে নিম্নমুখী। তাই শর্টকাট কোনো পদ্ধতি অবলম্বন না করে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাটাই হবে যুক্তিযুক্ত। আবেগ নয়, তথ্য ও যুক্তির ওপর ভর করেই আমাদের এ যাত্রায় অগ্রসর হতে হবে।
অনলাইনে ক্লাস গ্রহণে আমার নিজের একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে চাই। যার মধ্যদিয়ে পাঠক সহজেই এ সংক্রান্ত একটা সুস্পষ্ট ধারণা পেতে পারেন। আমি নিজে গত ১০ মে বিবিএ চতুর্থ ব্যাচের ক্লাস প্রতিনিধির মাধ্যমে গতকাল (১২ মে) দুপুর ২টায় জুম অ্যাপসের মাধ্যমে অনলাইনে ক্লাস নেয়ার সম্ভাব্যতা যাচাই করার জন্য একটি সেশন আয়োজন করেছিলাম। মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ২৯ জন অংশগ্রহণ করেছিল। যা মোট শিক্ষার্থীর ৫০% এরও কম।
যারা অংশগ্রহণ করেছিল তাদের মধ্যে আবার ১০/১২ জন শুধু ভয়েস শেয়ার করতে পারছিল ভিডিও নয়। কারণ ইন্টারনেটের গতি অত্যন্ত স্লো। কেন বাকিরা অংশগ্রহণ করে নাই জানতে চাইলে যা জানা গেল, তা মোটাদাগে দাঁড়ায় তাদের পরিবারের আর্থিক অসচ্ছলতা। টাকা দিয়ে এমবি কিনে এ ধরনের ব্যয়বহুল শিক্ষাব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করা তাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব।
এ অভিজ্ঞতা শুধু যে আমার একার তা কিন্তু নয়। যারা অনলাইনে ক্লাস নিয়েছেন তাদের অভিজ্ঞতাও ঠিক আমার অনুরূপ। সুতরাং দেশের বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা করেই অনলাইনে ক্লাস বা প্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। জাতি কোনো তাড়াহুড়ো চায় না।