অনলাইন বাড়ছে ইস্যু ভিত্তিক ‘নিষিদ্ধ জুয়া’

 

২৬ ফেব্রুয়ারি,২০২৩

অনলাইন বাড়ছে ইস্যু ভিত্তিক ‘নিষিদ্ধ জুয়া’

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আরটিএনএন
ঢাকা: দেশে জুয়া খেলা নিষিদ্ধ হলেও ব্যক্তিগতভাবে দুজন বা ততোধিক ব্যক্তির মধ্যে ফুটবল বা ক্রিকেট খেলার ফলাফল নিয়ে, বা অন্য কিছু নিয়ে ‘বাজি’ ধরে বিজয়ীকে অর্থ বা মূল্যবান বস্তু দেয়ার চল রয়েছে।

আবার অনেক ক্লাব, অভিজাত এলাকা এমনকি ঘরের ভেতরে জুয়ার আসর বসার ঘটনাও নতুন নয়।

তবে এই জুয়া সাম্প্রতিক সময়ে ডিজিটাল মাধ্যমে নতুন রূপ পেয়েছে। এ কারণে ঘরে বসেই মানুষ অনলাইনে বিভিন্ন জুয়ার অ্যাপ বা ওয়েবসাইটে অ্যাকাউন্ট খুলতে পারছেন।

এতে অনেক সময় তাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানার সুযোগ থাকছে না।

জুয়া নিষিদ্ধ হলেও এসব জুয়ার সাইটের বিজ্ঞাপন যেমন বাংলাদেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে দেখা গেছে এবং ইউটিউব চ্যানেলগুলোতেও প্রচার হতেও দেখা যাচ্ছে।

ইউটিউবে সম্প্রচারিত ধারাবাহিক নাটকে এমনই একটি অনলাইন জুয়ার সাইটের বিজ্ঞাপন প্রচার করায় বাংলাদেশের জনপ্রিয় এক ইউটিউবার এবং তার দুই সহযোগীকে গ্রেফতার করেছে ডিবি পুলিশ।

চব্বিশে ফেব্রুয়ারি তাদের নারায়ণগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।

গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাদের সঙ্গে ভারতীয় এক জুয়ার এজেন্টের গত তিন বছর ধরে জুয়ার বিজ্ঞাপন প্রচারের চুক্তি রয়েছে।

সেই চুক্তি অনুযায়ী, অভিযুক্তরা তাদের নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলের এক ওয়েব সিরিজে নিয়মিত বিজ্ঞাপন প্রচার করে আসছে। জুয়ার ব্যবসা প্রচারে বিজ্ঞাপনগুলো এখনও চলছে।

প্রতি পর্বে একেকটি বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য ওই ভারতীয় এজেন্টের থেকে অভিযুক্তরা ৭০ হাজার থেকে এক লাখ ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত চার্জ করতো বলে জানিয়েছে পুলিশ।

অভিযুক্তরা মূলত ওয়ানএক্সবেট, বাবুএইটিএইট, ক্রিকেক্স নামের জুয়ার সাইটের বিজ্ঞাপন প্রচার করতেন। এই সাইটগুলোয় ডলারের মাধ্যমে জুয়া খেলা হয়।

সাইটগুলোর ইউজার বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে এজেন্টের মাধ্যমে এটা পরিচালনা করা হয়।

পুলিশ জানিয়েছে, ভারতীয় ওই এজেন্সির সঙ্গে বাংলাদেশি এক এজেন্ট কাজ করতেন। তার কাজ ছিল ভারতীয় এজেন্টদের সাথে বাংলাদেশের জনপ্রিয় ইউটিউবার বা অনলাইন ইনফ্লুয়েন্সারদের যোগাযোগ করিয়ে দেয়া।

অভিযুক্তরা যে সাইটের বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য আটক হয়েছেন একই সাইটের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ায় এর আগে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেট তারকা সাকিব আল হাসান। পরে তিনি চুক্তি বাতিল করেন।

গত বছর অনলাইনে জুয়া খেলার অভিযোগে নয় জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এরা মূলত ফুটবল ক্রিকেটের মতো খেলার আসর ও খেলোয়াড়দের নিয়ে অনলাইনে জুয়ার আসর বসাতো।

গ্রাহকরা অনলাইনে ওই জুয়ার অ্যাপ বা ওয়েবসাইটে মোবাইল নম্বর বা ইমেইলের মাধ্যমে একাউন্ট খুলতেন এবং তার বিপরীতে ই-ওয়ালেট খুলে ব্যালেন্স যোগ করে ওই টাকায় জুয়া খেলতেন।

জুয়া বাবদ মোবাইল ওয়ালেট ছাড়াও ব্যাংকিং চ্যানেলে সেসময় প্রতিদিন তিন থেকে পাঁচ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে বলেও পুলিশ জানতে পারে। আবার অনেকে এজেন্টের মাধ্যমে নগদে জুয়ার টাকা লেনদেন করেছেন।

প্রতিটি জুয়ার সাইট দেশের বাইরে থেকে পরিচালিত হওয়ায়, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

ডিবি সাইবার ক্রাইম ইউনিটের উপ-কমিশনার তারেক বিন রশিদ বলেন, অনলাইনে জুয়ারিদের একটি চক্র দেশের বাইরে থেকে এসব অনলাইন বিজ্ঞাপনের কার্যক্রম পরিচালনা করে। সেইসাথে অনলাইনে অর্থ লেনদেনের সুযোগ থাকায় কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। কারণ এসব বেটিং অ্যাপ, ওয়েবসাইট বিদেশ থেকে পরিচালিত হয়। তাই এসব টাকা কোন না কোন ভাবে বিভিন্ন হাত ঘুরে দেশের বাইরেই যায়।

যেভাবে প্রচারণা হয়
তবে পুলিশ যে ইউটিউবারকে গ্রেফতার করেছে তিনি বা তার দুই সহযোগীর কারও জুয়া খেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার কোন প্রমাণ মেলেনি।

তাদের ইউটিউব চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা বর্তমানে ৪৫ লাখের মতো। তারা মূলত এই চ্যানেলটির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক জুয়ার সাইটের বিজ্ঞাপন প্রচারের দায়েই গ্রেফতার হয়েছেন।

তাদের বিজ্ঞাপন প্রচারের পদ্ধতিও ছিল বেশ আলাদা। নাটকের ফাঁকে ফাঁকে ৩০ সেকেন্ড বা এক মিনিট ধরে ওই জুয়ার সাইট নিয়ে অভিনেতারা কথা বলতেন বা বিজ্ঞাপনী সংলাপ দিতেন। সম্প্রতি ইউটিউব, ফেসবুক ভিডিওতে বিজ্ঞাপনের নতুন এই ধারার প্রচলন শুরু হয়।

দীর্ঘদিন ধরেই পুলিশের নজরদারিতে ছিলেন ওই ইউটিউবার ও তার সহযোগীরা। পরে পুলিশ বাদী হয়ে তাদের বিরুদ্ধে রমনা থানায় মামলা করলে তাদের গ্রেফতার করা হয়।

ডিবি সাইবার ক্রাইম ইউনিটের উপ-কমিশনার তারেক বিন রশিদ বলেন, তারা দীর্ঘদিন ধরেই অনলাইনে জুয়ার বিজ্ঞাপন দিয়ে আসছিল। তাদের গ্রেফতার করার পর আমরা জানতে পারি যে, অনলাইনে জুয়ারিদের একটি চক্র দেশের বাইরে থেকে এসব অনলাইন বিজ্ঞাপনের কার্যক্রম পরিচালনা করে।

তাদের তৈরি ভিডিও ও নাটক তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয় হওয়ায় এসব বিজ্ঞাপন দেখে অনেকে আসক্ত হয়ে যেত। এ থেকে আরও অনেক অপরাধের জন্ম হওয়ার আশঙ্কা থাকে বলে তিনি জানিয়েছেন।

এমন অবস্থায় ইউটিউব বা অন্য কোন মাধ্যমে জুয়ার প্রচারণা দেখলে পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটে অভিযোগ জানানোর পরামর্শ দেন তিনি।

তবে শুধু ইউটিউব নয় বাংলাদেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলেও প্রকাশ্যে জুয়ার বিজ্ঞাপন প্রচার করতে দেখা গিয়েছে।

সেখানে কেবল বেটিংয়ের ইংরেজি বানানটি ব্যাট লিখে বসানো হয়।

পরে গত ১১ই ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী খন্দকার হাসান শাহরিয়ার এবং ঢাকা জজ কোর্টের আইনজীবী ইসমাতুল্লাহ লাকী তালুকদার বেটিং সাইটের বিজ্ঞাপন প্রদর্শন বন্ধে ওই বেসরকারি টিভি চ্যানেলটিকে লিগ্যাল নোটিশ দেন।

ওই নোটিশে বেটিং সাইটের বিজ্ঞাপন ও লোগো প্রচার, প্রকাশ, সম্প্রচার সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করার পাশাপাশি অদূর ভবিষ্যতেও সব প্রকার জুয়ার সাইটের বিজ্ঞাপন প্রচার, প্রকাশ তথা সম্প্রচার থেকে বিরত থাকার জন্য তিন দিনের সময় দিয়ে লিগ্যাল নোটিশ পাঠানো হয়।

এ ব্যাপারে চ্যানেলটির বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য মন্ত্রিপরিষদ সচিব, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিবকেও লিগ্যাল নোটিশ পাঠানো হয়েছে।

বিষয়টি আদালতে প্রক্রিয়াধীন আছে বলে জানায় পুলিশ। এছাড়া প্রতিনিয়ত বেটিংয়ের অসংখ্য ওয়েবসাইট ও অ্যাপ চালু হচ্ছে।

ডিবি সাইবার ক্রাইম ইউনিট জানায়, তারা এসব সাইট নিয়মিত নজরদারিতে রাখছে এবং একাধিক সাইট ব্লক করার জন্য বিটিআরসির কাছে নিয়মিত রিপোর্ট করা হচ্ছে।

সম্প্রতি দেশের অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্ক থেকে অনলাইন জুয়ার ৩৩১টি ওয়েবসাইট বন্ধ করে দিয়েছে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি।

গুগল প্লে স্টোর থেকে জুয়া বিষয়ক অ্যাপ বন্ধের জন্য গুগল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে রিপোর্ট করেছে বিটিআরসি। এরি মধ্যে বেশ কয়েকটি অ্যাপ বন্ধ হয়ে গিয়েছে, বাকিগুলো যাচাই বাছাই করা হচ্ছে বলে জানানো হয়েছে।

তবে অনলাইনে রাতারাতি সব ওয়েবসাইট ব্লক করে দেয়া রীতিমতো অসম্ভব বলে জানান ডিবি সাইবার ক্রাইম ইউনিটের উপ-কমিশনার তারেক বিন রশিদ।

তিনি বলেন, অনলাইনে অসংখ্য জুয়ার সাইটের সব বন্ধ করা সম্ভব না। একটি ওয়েবসাইট বন্ধ করলে ভিন্ন নামে আরও ১০টি সাইট খুলে যায়। ডিজিটাল যুগে ডিজিটাল মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা বিশ্বের কোথাও নেই। জুয়ারিরা এই ওপেন মিডিয়াগুলো ব্যবহারের সুযোগ নিয়েই ছড়িয়ে পড়ছে।

বাংলাদেশের আইন যুগোপযোগী নয়
এখনও অনেক দেশে জুয়া খেলা আইনগতভাবে বৈধ হওয়ায় অনলাইনে এর ব্যাপ্তি ক্রমশ বাড়ছে।

ওয়ার্ল্ড গ্যাম্বলিং মার্কেট রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২২ সালে শুধুমাত্র অনলাইন জুয়ার বাজারমূল্য ছিল ৬৩৫৩ কোটি মার্কিন ডলার। ২০২৩ সালে এর ব্যাপ্তি ১১.৭% বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এবং এই অনলাইন জুয়ায় বাজারমূল্যের গ্রাফ ক্রমশ উর্ধ্বমুখী।

তবে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ এর সংবিধানে জুয়া খেলা নিরোধ করা হয়।

সংবিধানের ১৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, গণিকাবৃত্তি ও জুয়াখেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

জুয়া প্রতিরোধে প্রচলিত আইনেও জুয়া খেলা অবৈধ। কিন্তু এ আইন ১৮৬৭ সালে অর্থাৎ ব্রিটিশ আমলে প্রণীত এবং এতে সাজার পরিমাণও খুব নগণ্য।

পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট অনুযায়ী, যে কোনও ঘর, স্থান বা তাঁবু জুয়ার আসর হিসেবে ব্যবহৃত হলে তার মালিক বা রক্ষণাবেক্ষণকারী, জুয়ার ব্যবস্থাপক বা এতে কোনও সাহায্যকারী তিন মাসের কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব ২০০ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।

এ রকম কোনও ঘরে তাস, পাশা, কাউন্টার বা যেকোনো সরঞ্জামসহ কোনও ব্যক্তিকে জুয়া খেলারত বা উপস্থিত দেখতে পাওয়া গেলে তিনি এক মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড বা ১০০ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।

অর্থাৎ এই আইন শুধুমাত্র প্রকাশ্য জুয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এবং দণ্ডবিধি বর্তমান বাস্তবতার সাথে উপযোগী নয় বলেই পুলিশের মত।

২০১৯ সালে রাজধানীতে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে বিভিন্ন জুয়ার আসর থেকে শতাধিক ব্যক্তি আটক হলে আইনের সীমাবদ্ধতার বিষয়টি তখন আলোচনায় আসে।

তখন অবশ্য এই আইনে কোন মামলা দেয়া হয়নি। তবে ১৫৬ বছরের পুরনো আইন সংশোধন করে একে যুগোপযোগী করা জরুরি বলে জানিয়েছে পুলিশ।

মন্তব্য

মতামত দিন

অর্থনীতি পাতার আরো খবর

বাংলাদেশ-ভারত বিমান চলাচল শুরু

নিউজ ডেস্কআরটিএনএনঢাকা: করোনাভাইরাস মহামারির কারণে সাত মাসেরও বেশি সময় বন্ধ থাকার পর বুধবার থেকে শুরু হয়েছে বাংলাদেশ ও . . . বিস্তারিত

যেসব দেশ থেকে বাংলাদেশ খাদ্যপণ্য আমদানি করে

নিউজ ডেস্কআরটিএনএনঢাকা: সম্প্রতি ভারত বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করার পর, হঠাৎ করে দেশে পেঁয়াজের দাম কয়েকগুণ বেড়ে . . . বিস্তারিত

 

 

 

 

 

 

ফোন: +৮৮০-২-৮৩১২৮৫৭, +৮৮০-২-৮৩১১৫৮৬, ফ্যাক্স: +৮৮০-২-৮৩১১৫৮৬, নিউজ রুম মোবাইল: +৮৮০-১৬৭৪৭৫৭৮০২; ই-মেইল: rtnnimage@gmail.com