রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বার বার আগুন: নেপথ্যের কি কারণ

০৭ মার্চ,২০২৩

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বার বার আগুন: নেপথ্যের কি কারণ

নিউজ ডেস্ক
আরটিএনএন
ঢাকা: কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রোববার ভয়াবহ এক আগুনে দুই হাজারের বেশি ঘরবাড়ি এবং দোকানপাট পুড়ে গেছে। উখিয়ার বালুখালীর ক্যাম্পে আগুন লাগার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এসব বাড়িঘর পুড়ে যায়।

অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি ছাড়াও দাতা সংস্থার কিছু অফিস এবং কয়েক শ’ দোকানপাট আগুনে পুড়ে গেছে।

গত বছরের জানুয়ারি মাসে উখিয়ার একটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুন লেগে ছয় শ’ ঘরবাড়ি পুড়ে গিয়েছিল।

এর দুই মাস পর মার্চ মাসে এই বালুখালী ক্যাম্পেই আরেকটি অগ্নিকাণ্ডে ১০ হাজারের মতো ঘরবাড়ি পুড়ে যায়। তখন ১৫ জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছিল।

কিভাবে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল আগুন
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ঘনবসতিপূর্ণ ক্যাম্পটিতে ঘরগুলো কাঠ, বাঁশ ও ত্রিপল দিয়ে বানানো হওয়ায় এবং বাতাসের কারণে দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়েছে।

কর্মকর্তারা বলছেন, শুরুতে ১১ নম্বর ক্যাম্পে আগুন লাগলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই তা ১০ নম্বর ক্যাম্পে ছড়িয়ে পড়ে।

শেষ পর্যন্ত বেলা ৪টা নাগাদ ৬ নম্বর ক্যাম্পেও আগুন ছড়িয়ে পড়ে।

কক্সবাজারের ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক অতীশ চাকমা জানান, তাদের কয়েকটি ইউনিটও আগুন নেভানোর কাজে অংশ নিয়েছে।

তবে ক্যাম্পের মধ্যে সরু গলিসহ নানা কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। বিশেষ করে ঢাল এলাকা, সরু পথ আর ঘনবসতির কারণে দমকল কর্মীরা আগুনের কাছাকাছি যেতে পারছিলেন না।

একটু পরপর বিকট শব্দে সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটছিল। তাছাড়া বাতাসের কারণে বাঁশ-কাঠ-কাগজ দিয়ে তৈরি ঘরগুলোতে দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে।

আগুন নিয়ে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব
উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একজন রোহিঙ্গা বিবিসি বাংলা বলেছেন, এই এলাকায় আধিপত্য বিস্তার এবং ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কয়েকটি গোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধ রয়েছে।

তিনি বলেন, সেখানে ‘আরাকান স্যালভেশন আর্মি- আরসা’, ‘আরাকান সলিডারিটি অর্গানাইজেশন- আরএসও, ‘আল-ইয়াকিনসহ রোহিঙ্গাদের ২০টির বেশি গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে। তাদের মধ্যে এর আগে সংঘর্ষ হয়েছে। গত এক মাসের মধ্যে তাদের মধ্যে সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন হতাহতও হয়েছে।

তিনি দাবি করেন, অন্য রোহিঙ্গাদের কাছে শুনেছেন, আগুন লাগানোর আগে বন্দুকধারী কিছু ব্যক্তি এসে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর ছেড়ে চলে যেতে বলেন। সেই সময় ফাঁকা গুলিও করা হয়। এরপর বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এই আগুনের ঘটনা ঘটলো এমন সময়, যার মাত্র এক দিন পরেই জেনেভায় জয়েন্ট রেসপন্স প্রোগ্রাম বা জেআরপির বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক মনোযোগ যাতে সরে না যায়, সেজন্য ৭ মার্চের ওই বৈঠকে জোর গুরুত্ব দেয়া হবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে।

এর মধ্যেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর রোহিঙ্গাদের জন্য বিভিন্ন দেশ ও দাতা সংস্থার সাহায্য কমতে শুরু করেছে। সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের জন্য মাথাপিছু খাদ্য সহায়তা কমিয়ে দিয়েছে বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (ডব্লিউএফপি)।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় এই আগুন নিয়ে আরো কিছু গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। রোহিঙ্গা নেতা একজন মাঝি বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, আগুনে ঘরবাড়ি পুড়ে গেলে বিদেশী সাহায্য আসবে, আন্তর্জাতিক মনোযোগ পাওয়া যাবে, এমন চিন্তা থেকেও আগুন লাগানো হয়ে থাকতে পারে বলে তারা মনে করছেন।

সেই সময় মোবাইলে ধারণ করা একটি ভিডিও দেখতে পেয়েছে বিবিসি বাংলা।

দূর থেকে ধারণ করা ওই ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, কয়েকজন ব্যক্তি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের একটি ঘরে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে। স্থানীয়রা বলছেন, এই ব্যক্তিরাও রোহিঙ্গা যদিও তাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

কেন বার বার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুন লাগছে?
স্থানীয় সাংবাদিক ও জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, গত পাঁচ বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় অনেক বার আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। এর বেশিরভাগই ঘটছে বিভিন্ন গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বের কারণে।

চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ডিসেম্বর ২০২২ পর্যন্ত দুই বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় মোট ২২২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৬৩টি আগুন নাশকতামূলক বা ইচ্ছে করে লাগানো হয়েছে। ৯৯টি অগ্নিকাণ্ড দুর্ঘটনাজনিত কারণে হয়েছে আর ৬৩টির কারণ জানা যায়নি।

সংসদীয় কমিটির ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় বর্তমানে ১০টি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে। আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে হত্যাকাণ্ড ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের একজন বাসিন্দা বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর আধিপত্য নিয়ে দ্বন্দ্বে এর বেশ কয়েকবার ক্যাম্পে আগুন দেয়া হয়েছে। এক গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকায় আরেক গ্রুপ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।

ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা অতীশ চাকমা বলছেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় তারা ঘরগুলো কাঠ, বাঁশ, প্লাস্টিক, কাগজ দিয়ে ঘরবাড়িগুলো তৈরি করে। এর সবগুলোই সহজ দাহ্য পদার্থ। আগুন নিয়ে তাদের সচেতনতারও অভাব রয়েছে। ফলে একবার কোনো বাড়িতে আগুন লাগলে তা দ্রুত আশেপাশের বাড়িঘর এবং পুরো ক্যাম্পেই ছড়িয়ে পড়ে।

‘আবার ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের যাতায়াতে সমস্যা থাকায় এবং পানির ভালো ব্যবস্থা না থাকায় আগুন লাগলে সেটা সহজে নেভানোও যায় না। প্রতিটা বাড়িতেই গ্যাসের সিলিন্ডার আছে, সেগুলোও দ্রুত আগুন ছড়িয়ে দেয়।’

পুরো রোহিঙ্গা ক্যাম্পেই আগুন লাগলে তা নেভানোর বা প্রতিরোধের কোনো ব্যবস্থা নেই বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।

কক্সবাজারের অষ্টম আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মোঃ আমির জাফর বলছেন, ‘অতীতে অনেক সময় যেমন দুর্ঘটনাবশত আগুন লেগেছে, তেমনি অনেক সময় নাশকতার অভিযোগও উঠেছে। আর ক্যাম্পে তাদের বাড়িঘরগুলো এমনভাবে তৈরি করা যে কোনো বাড়িতে আগুন লাগলে তা পুরো ক্যাম্পে ছড়িয়ে পড়ে।‘

কর্মকর্তারা কী বলছেন
আগুনের ঘটনা যাচাই করে দেখার জন্য একটি কমিটি গঠন করেছে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন, যারা গতকাল সোমবার থেকে কাজ শুরু করেছেন।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান ও কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরান বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, আগুনের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন না দেখে তারা এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চান না।

তদন্ত কমিটির একজন সদস্য ও কক্সবাজার ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা অতীশ চাকমা বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘আমরা আজকে বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গার সাক্ষ্য নিয়েছি, আগামীকালও নেব। যেসব গুজবের কথা আপনি বলছেন, তা আমরাও শুনেছি। কিন্তু আমরা প্রত্যক্ষদর্শীদের সাথে কথা বলে, তাদের সাক্ষ্য নিয়ে আগুন লাগার কারণ বের করব।’

তিনি বলেন, তাতে হয়ত আমাদের তিন-চারদিন লেগে যাবে। তার আগে আগুন লাগার কারণ বলতে পারছি না।

মন্তব্য

মতামত দিন

জাতীয় পাতার আরো খবর

পুলিশ প্রধান ও র‍্যাব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার অর্থ কী

নিজস্ব প্রতিবেদকআরটিএনএনঢাকা: গুরুতর মানবাধিকার লংঘনমূলক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে বাংলাদেশের পুলিশের এলিট ফোর্স র‍্য . . . বিস্তারিত

কোনো নিয়মেই থামছে না ঘরমুখী মানুষের স্রোত

নিজস্ব প্রতিনিধিআরটিএনএনমুন্সীগঞ্জ: কোনো আইন-কানুনই আটকাতে পারছে না শিমুলিয়ার জনস্রোত। প্রশাসনের সকল কৌশল টপকিয়ে যাত্রীদ . . . বিস্তারিত

 

 

 

 

 

 

ফোন: +৮৮০-২-৮৩১২৮৫৭, +৮৮০-২-৮৩১১৫৮৬, ফ্যাক্স: +৮৮০-২-৮৩১১৫৮৬, নিউজ রুম মোবাইল: +৮৮০-১৬৭৪৭৫৭৮০২; ই-মেইল: rtnnimage@gmail.com