বার্সেলোনা যেভাবে নারীবান্ধব শহর হয়ে উঠলো

০৫ নভেম্বর,২০১৯

বার্সেলোনা যেভাবে নারীবান্ধব শহর হয়ে উঠলো

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আরটিএনএন
বার্সেলোনা: বিশ্বের প্রতিটি বড় শহরই নয় সবগুলো শহরই আসলে সবার জন্যই জনবান্ধব হওয়া উচিত, কিন্তু সেটি আসলে হয়নি।

বছরের পর বছর ধরে শহরের নকশা এবং নির্মাণ করে আসছেন পুরুষরা। কিন্তু নারীরা যদি শহর বানাতে শুরু করেন, তাহলে সেটি কেমন হবে? এর উত্তর হয়তো পাওয়া যাবে বার্সেলোনার কাছে। খবর বিবিসি বাংলার

গত চার বছর ধরে এই শহরের মেয়র একজন নারী, যার নারীবান্ধব বেশ কিছু লক্ষ্য আছে।

নগর নকশা নিয়ে কাজ করেন এরকম বেশ ক'জন নারীবাদী নকশাবিদের সঙ্গে কথা বলেছে বিবিসি এবং জানার চেষ্টা করেছে, নারীবান্ধব একটি শহর নির্মাণের জন্য কী ধরণের পরিবর্তন আনা দরকার?

বার্সেলোনার নগরায়ন বিষয়ক কাউন্সিলর জ্যানেট স্যানয এই উদ্যোগটা শুরু করেছেন। এটা আসলে অনেক বড় আর উচ্চাকাঙ্ক্ষী একটি পরিকল্পনার অংশ।

তিনি বলেন, আপনি বিষয়টা নিয়ে ভাবুন, বার্সেলোনার প্রায় ৬০ শতাংশ স্থান গাড়ির কাজে ব্যবহার হচ্ছে। যখন আপনি এই জায়গা পুনরায় বরাদ্দ করতে শুরু করবেন, আপনি সেইসব মানুষকে সহায়তা করবে, যারা এখনো এসব জায়গার কোন সুবিধা পাচ্ছে না।

তিনি বলেন, ক্যাটালানে সুপারইলিস বা সুপার বুক নামের একটি পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে, যার মাধ্যমে পথচারী, সাইকেল চালক বা শুধুমাত্র আড্ডা দেয়ার জন্য এসব জায়গা বরাদ্দ নেয়া যাবে।

তারা বার্সেলোনার শহরের বিশেষ গ্রিড বিন্যাসের মধ্য থেকে নয়টি ব্লক বেছে নিয়ে একটি বিশাল (সুপার ব্লক) ব্লক তৈরি করেছে, যেখানে যান চলাচল প্রায় বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। যেসব গাড়ির অনুমতি রয়েছে শুধু সেগুলোই প্রবেশ করতে পারে।

সেখানে গাড়ির গতিসীমা হবে ঘণ্টায় ১০ কিলোমিটার এবং গাড়িগুলোকে থাকতে রাখতে হবে আন্ডারগ্রাউন্ডে।

সুতরাং পার্কিংয়ে ব্যস্ত রাস্তার বদলে সেটা পরিণত হয়েছে পিকনিক বেঞ্চ এবং খেলাধুলা করার স্থানে।

জ্যানেট স্যানয এবং তার দল চেষ্টা করেছেন, এটি যেন সামাজিক যোগাযোগের একটি কেন্দ্রে পরিণত হয়।

বার্সেলোনা শহর জুড়ে এরকম ছয়টি স্থান তৈরি করা হয়েছে এবং আরো পাঁচশর বেশি জায়গা তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে।

বার্সেলোনার বাসিন্দারা পার্টি বা অনুষ্ঠান করতে পছন্দ করে এবং সিটি কাউন্সিল মনে করে, প্রকাশ্য স্থানে সবার আনন্দ করার অধিকার আছে, সেটি দিনে বা রাতে যে কোনো সময়েই হতে পারে।

এখানে এসে নারী বা পুরুষ যৌন হয়রানি বন্ধ করার ব্যাপার পরামর্শ সহায়তা নিতে পারেন।

ব্যস্ত একটি নাইট লাইফের সময় লরা মার্তি মারর্তোরেলের মতো তথ্য কর্মকর্তারা পুরো এলাকা জুড়ে ঘুরে বেড়াতে থাকেন, তরুণ-তরুণীদের ওপর নজর রাখেন এবং তাদের জানান যে, তারা যদি কোন সমস্যায় পড়ে, তাহলে কাছেই সাহায্য পাওয়া যাবে।

সিটি কাউন্সিল একটি অ্যাপ চালু করেছে। যৌন হয়রানির শিকার হলে বা এরকম কোন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হলে নিজের নাম প্রকাশ না করেই ওই অ্যাপে রিপোর্ট করতে পারবেন, বলছেন লরা।
অনেক বাথরুম

এটা এমন একটা সমস্যা, যার সঙ্গে বিশ্বের সব নারীরাই পরিচিত। পুরুষদের তুলনায় নারীদের বাথরুমে যাওয়ার জন্য সবসময়েই তাদের বেশি লম্বা লাইনে অপেক্ষা করতে হয়। আর এর পেছনে সহজ কয়েকটি কারণ রয়েছে।

পুরুষরা যখন দাঁড়িয়ে মূত্র ত্যাগ করতে পারে, নারীদের সেখানে টয়লেটে বসতে হয়, যার ফলে একজন পুরুষের তুলনায় সাধারণত একজন নারীর তিনগুণ সময় বেশি লাগে।

নারীদের অনেক সময় টয়লেট বেশি ব্যবহার করার দরকার হয়- যেমন রজঃস্রাবের সময় অথবা অন্তঃসত্ত্বা থাকার সময়ে।

বিশ্বের প্রায় সর্বত্র নারীরাই হচ্ছেন ঘনিষ্ঠ জনের যত্নআত্তির প্রধান ব্যক্তি, ফলে অন্যদের সহায়তা করার জন্যেও তাদের অনেক সময় টয়লেটে যেতে হয়।

নকশাকার ব্লাঙ্কা ভালদিভিয়া বলেন, অনেক মা আমাদের বলেছেন, তারা পাবলিক টয়লেটে যান না। কারণ, তারা শিশুকে প্রামে (যেসব চাকা লাগানো ছোট চেয়ারে শিশুদের বহন করা হয়) নিয়ে বের হলে, টয়লেটে প্রামগুলো ঢোকানো যায় না।

তাই তারা টয়লেটই ব্যবহার করেন না।

পাশাপাশি, পুরুষদের মূত্রস্থানের তুলনায় একটি টয়লেট স্থাপনে দুই থেকে তিনগুণ বেশি জায়গা লাগে।

সুতরাং থিওরি অনুযায়ী, নারীদের টয়লেটের জন্য অন্তত তিনগুণ জায়গা বেশি লাগে এবং এরকম টয়লেটের সংখ্যাও বেশি হওয়া উচিত।

কিন্তু যখন কোন ভবনের নকশা করা হয়, তখন খুব কম সময়েই এই বিষয়টি বিবেচনায় রাখা হয়।
খেলার জায়গা

আমরা উপলব্ধি করতে পারি আর না পারি, যেসব জায়গা আমরা ব্যবহার করি, সেগুলো আসলে প্রতিটা পৃথক, এমনকি খেলার জায়গাও।

নগর পরিকল্পনা গ্রুপ ইক্যুয়েল সারির একজন নকশাকার ডাফনি সালডানা, যিনি খেলাধুলার ব্যাপারে বৈষম্য কমিয়ে আনতে চান।

তিনি বলছেন, আপনি যদি নকশার ব্যাপার নিয়ে ঠিকভাবে না ভাবেন, তাহলে অনেক সময় আপনি শহরের মধ্যখানে একটি অভিন্ন জায়গা দেখতে পাবেন।

এ জায়গাটি বেশিরভাগ সময়েই একটি উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। সেটি হচ্ছে ফুটবল।

ডাফনি বলেন, যখন সেখানে এ জাতীয় খেলা থাকে, সেটি অনেক জায়গা নিয়ে নেয়, ফলে অন্য কোন খেলাধুলার জন্য কোন জায়গা থাকে না।

ইক্যুয়েল সারি সম্প্রতি বার্সেলোনার কাছাকাছি একটি শহরতলিতে খালি একটি জায়গাকে খেলার স্থানে রূপান্তরিত করেছে।

তারা রঙ, নানা ধরণের মেঝে, গাছপালা এবং বাইরের আসবাবপত্র দিয়ে এলাকাটিকে নানাভাগে ভাগ করে দিয়েছে।

ফলে স্থানটি অনেকগুলো অংশে বিভক্ত হয়ে গেছে, যেখানে নানা ধরণের খেলাধুলা করার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

ফলে এই জায়গাটি শুধুমাত্র কোন একটি গ্রুপ বা কোন একটি খেলার জন্য আর ব্যবহারের সুযোগ নেই।

পরিবর্তনের জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হলো, সবার মতামত শোনা। তারা সমাজের সবাইকে, তরুণ, বৃদ্ধ, পুরুষ ও নারী- সবাইকে জিজ্ঞেস করেছে যে এই খালি জায়গায় তারা কি চান?

এবং প্রায় সবার উত্তরে একটা বিষয় ছিল....

ইক্যুয়াল সারি এবং পুন্ট সিক্সের মতো সামাজিক পরিবর্তনের জন্য কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে এটি নিয়ে বিশেষ মোহ আছে।

পুন্ট সিক্সের ব্লাঙ্কা ভালডিভিয়া বলেন, এটা শুধুমাত্র সামাজিক একটি বিষয় নয়, যেসব মানুষ অসুস্থ, যাদের প্রতিবন্ধীত্ব আছে বা যাদের যত্ন নিতে হয়, তাদের চলাফেরার জন্য একটি মৌলিক চাহিদার বিষয়। এখানে বসার আসনের অনেক অভাব রয়েছে এবং এর ফলে অনেকে স্থানগুলো ব্যবহার করতে পারেন না।

বার্সেলোনার কর্তৃপক্ষ শুধুমাত্র একেকটি এলাকাতেই পাঁচশোর বেশি বসার আসন স্থাপন করেছে।
সড়কের নামের মধ্যে কী আছে?

একটি শহরকে নারীবান্ধব করার মানে এই নয় যে, সেখানে নারীরা শুধুমাত্র নিজেদের নিরাপদ বোধ করবে। আসলে সেখানে নারীদের উপস্থিতির ব্যাপারটিও পরিষ্কার হতে হবে।

কারণ, আপনি যদি ভেবে দেখেন, আমাদের ইতিহাসের বইয়ের মতো আমাদের শহরগুলোও যেন পুরুষদের অর্জনকে তুলে ধরছে।

বিশ্বের সাতটি বড় শহরের ওপর চালানো একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, মাত্র ২৭.৫ শতাংশ সড়কের নাম নারীদের নামে রয়েছে।

এই সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করছে বার্সেলোনা। শহরের সর্বশেষ কর্তৃপক্ষ নতুন সড়কগুলোর অর্ধেক নামকরণ নারীদের নামে করেছে।

এখনকার সিটি কাউন্সিল সেটিকে ৬০ শতাংশ করার জন্য ব্যবস্থা নিচ্ছে। নারীদের নির্মিত একটি শহর দেখার ব্যাপারটি এখনো কল্পনার মধ্যে রয়েছে।

কিন্তু বার্সেলোনা থেকে আমরা হয়তো একটা আভাস পেতে পারি যে, ভবিষ্যতে সেটা কেমন হতে চলেছে।

মন্তব্য

মতামত দিন

ইউরোপ পাতার আরো খবর

বেলারুশ একটি ক্ষুদ্র বিমান ঘাঁটি থেকে রুশ বিমান ধ্বংস করেছে

আন্তর্জাতিক ডেস্কআরটিএনএনঢাকা: বেলারুশের নির্বাসিত বিরোধী দলীয় নেতা রোববার বলেছেন, তার পক্ষের যোদ্ধারা রাজধানী মিনস্কের . . . বিস্তারিত

ধ্বংসস্তূপ থেকে বাবাকে নিয়ে ছোট্ট মেয়ের আবেগঘন চিরকুট

আন্তর্জাতিক ডেস্কআরটিএনএনঢাকা: নাসির আলওয়াকা। বহু ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করা এক সিরীয়। বাস করেন দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় এল . . . বিস্তারিত

 

 

 

 

 

 

ফোন: +৮৮০-২-৮৩১২৮৫৭, +৮৮০-২-৮৩১১৫৮৬, ফ্যাক্স: +৮৮০-২-৮৩১১৫৮৬, নিউজ রুম মোবাইল: +৮৮০-১৬৭৪৭৫৭৮০২; ই-মেইল: rtnnimage@gmail.com