Image description

নিউজ ডেস্ক 
আরটিএনএন: চলামান উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে দলীয় নিষেধের পরেও আওয়ামীলীগের এমপি-মন্ত্রীদের প্রভাব বিস্তার কমছে। ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে উঠছে এমপি-মন্ত্রী ও তাদের স্বজনরা।

ভোটের শুরুতে আওয়ামী লীগ কড়া ভাষায় নির্দেশনা দিয়েছিল, এমপি-মন্ত্রীর পরিবারের সদস্য বা স্বজনদের ভোটে মাঠে না রাখার জন্যও সতর্ক করা হয়েছিল। দেওয়া হয়েছিল সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকিও। কিন্তু কোনো কিছুতেই কাজ হয়নি। প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের পর তৃতীয় ধাপের নির্বাচন থেকেও সরানো যায়নি এমপি পরিবারের সদস্যদের। চতুর্থ ধাপের নির্বাচনে প্রস্তুতিও শুরু করেছেন অনেকেই। এছাড়া কেন্দ্রের নির্দেশনা অমান্য করে অনেক এমপিই প্রকাশ্যে বা পরোক্ষভাবে মাঠে নেমেছেন পছন্দের প্রার্থীদের নিয়ে।

তাদের জেতাতে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগও উঠেছে অনেকের বিরুদ্ধে। স্থানীয় অনেক এমপি আবার নানা কায়দায় দল ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে মাঠে নামানোর চেষ্টাও চালাচ্ছেন। তৃণমূলের নেতাকর্মী ও প্রার্থীদের অভিযোগ-নির্দেশনা অমান্য করার পরও সাংগঠনিক ব্যবস্থা না নেওয়ায় আরও ‘বেপরোয়া’ আচরণ করছেন অনেক এমপি।

 উপজেলা নির্বাচনে এমপি-মন্ত্রীর স্বজনদের প্রার্থিতা প্রসঙ্গে রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, দলীয় নির্দেশ অমান্য করলে তাদের শাস্তি পেতেই হবে। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে ৭৩ জন এমপি মনোনয়ন পাননি, ২৫ জন কেবিনেটে বাদ পড়েছেন-শাস্তিটা অনেকভাবেই আসতে পারে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যে কোনো মূল্যে উপজেলার রাজনীতি নিজেদের কবজায় রাখতে মরিয়া স্থানীয় এমপিরা। আওয়ামী লীগের নির্দেশনার পরও প্রথম ধাপে অন্তত ১৩ উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে এমপি-মন্ত্রীর স্বজনরা মাঠে ছিল। এর মধ্যে নয়জন বিজয়ী হয়েছেন। বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতও হয়েছেন দুজন। প্রায় সব জায়গায়ই স্বজনদের জয়ের পেছনে মূল ভূমিকা ছিল সংশ্লিষ্ট আসনের এমপির। এছাড়া স্বজন না হলেও বিজয়ীদের অনেকেই ছিলেন (স্থানীয় এমপি-মন্ত্রীর) পছন্দের প্রার্থী। এসব উপজেলার পরাজিত প্রার্থীদের অনেকেই ভোটের পরে সরাসরি অভিযোগ তুলেছেন স্থানীয় এমপিদের বিরুদ্ধে। তাদের দাবি-এমপিরা তাদের স্বজন বা পছন্দের প্রার্থীদের জেতাতে নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করেছেন।

এদিকে দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে মাঠে আছেন অন্তত ২০ এমপির স্বজন। তাদের মধ্যে আছেন-এমপির স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, ভাই-ভাতিজা, শ্যালক, ভগ্নিপতি, মামা-ভাগ্নে, বেয়াই। এছাড়া পছন্দের প্রার্থীরা তো আছেনই। তাদের জেতাতে নানা কায়দায় চেষ্টা চালাচ্ছেন এমপিরা।

পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন আনারস প্রতীকের চেয়ারম্যান প্রার্থী বাকী বিল্লাহ। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান। বাকী বিল্লাহ পাবনা-৩ আসনের সংসদ-সদস্য মকবুল হোসেনের ছেলে চেয়ারম্যান প্রার্থী গোলাম হাসনাইন রাসেলের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। রোববার পাবনা প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে বাকী বিল্লাহ বলেন, রাসেল আমার কর্মী-সমর্থকদের ওপর নানা অত্যাচার-নির্যাতন করছে। হামলা-মামলার ভয় দেখানোর কারণে তারা হতাশাগ্রস্ত। এমন পরিস্থিতিতে আমার নির্বাচন করা মোটেও সম্ভব নয়। তাই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালাম।

শরীয়তপুর সদর উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী বিল্লাল হোসেন দিপু মিয়া মঙ্গলবার শরীয়তপুর শহরের রূপনগরে নিজ বাসায় সংবাদ সম্মেলন করেন। এ সময় তিনি প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী উজ্জল আকনকে স্থানীয় সংসদ সদস্য ইকবাল হোসেন অপুর প্রার্থী হিসাবে আখ্যায়িত করে তাদের বিরুদ্ধে প্রচারণায় বাধা, হত্যার হুমকি, মারধরসহ নানা অভিযোগ করেন। শঙ্কা প্রকাশ করে বিল্লাল হোসেন দিপু মিয়া বলেন, আমাকে যদি হত্যা করা হয় বা আমার জীবনের কোনো ক্ষতি হয় তাহলে তার জন্য স্থানীয় সংসদ সদস্য ইকবাল হোসেন অপু দায়ী থাকবে। আমি বাঁচতে চাই, আমি সুস্থ একটি প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন চাই।

লক্ষ্মীপুর-১ (রামগঞ্জ) আসনের এমপি আনোয়ার হোসেন খানের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। দ্বিতীয় ধাপে আগামী ২১ মে রামগঞ্জ উপজেলায় নির্বাচন হবে। বৃহস্পতিবার রাতে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ইমতিয়াজ আরাফাত (আনারস প্রতীক) অভিযোগ করেন-এমপি পৌরসভার মেয়র, কাউন্সিলর, ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যদেরকে (মেম্বার) উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী দেলোয়ার হোসেন দেওয়ান বাচ্চুর (মোটরসাইকেল প্রতীক) পক্ষে কাজ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। এ ঘটনায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আরাফাত প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ ৭টি দপ্তরে লিখিত অভিযোগ পাঠিয়েছেন।

আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের কয়েক নেতা এবং উপজেলার প্রার্থীর মতে, শুরুতে কেন্দ্র থেকে হুঁশিয়ারি দেওয়ার পর অনেকেই কিছুটা ভয় পেয়েছিলেন। অনেকেই একটু ধীরে চলে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করেছেন। সাংগঠনিক দায়িত্বপ্রাপ্তদের সঙ্গে কথা বলেও সার্বিক বিষয়ে দলের কঠোর অবস্থান শেষ পর্যন্ত কতটা কঠোর হবে সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু পরে গুরুত্বপূর্ণ এমপি, মন্ত্রী ও নেতার পরিবারের সদস্যদের নির্র্দেশনা অমান্য করে মাঠে থাকা, কেন্দ্রীয় নেতাদের ভিন্ন ভিন্ন মন্তব্য এবং কারও বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো সাংগঠনিক ব্যবস্থা না নেওয়ায় অনেক এমপিই ‘বেপরোয়া’ হয়ে গেছেন বলে তারা মনে করেন। ফলে পরবর্তী ধাপের নির্বাচনে পছন্দের প্রার্থীদের জেতাতে তারা আরও বেশি প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করতে পারেন।

তৃতীয় ধাপের ভোটে প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন ছিল রোববার। এই ধাপে ১১২টি উপজেলায় ভোট হবে ২৯ মে। এই ধাপের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন এমপি তাদের পরিবারের সদস্য বা পছন্দের প্রার্থীদের নিয়ে মাঠে নেমেছেন। চতুর্থ ধাপের নির্বাচনের প্রস্তুতিও শুরু করেছেন অনেকেই। এছাড়া বেশ কয়েকজন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যের পরিবারের সদস্যরাও আছেন নির্বাচনি মাঠে। স্বতন্ত্র হলেও এসব এমপির সবাই আওয়ামী লীগ বা সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন পদে রয়েছেন।

উপজেলা নির্বাচন গ্রহণযোগ্য ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে দলীয় প্রার্থী দেয়নি আওয়ামী লীগ। এছাড়া সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাবমুক্ত রাখতে চেয়েছিল আওয়ামী লীগ। এ বিষয়ে দলের পক্ষ থেকে তাদের একাধিকবার সতর্কও করা হয়েছিল। এমপি-মন্ত্রীর পরিবারের সদস্য বা স্বজনদের ভোটে না থাকার নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছিল কেন্দ্র থেকে। তবে এ নির্দেশনা মানেননি তারা। নানা যুক্তি দেখিয়ে মাঠে থেকেছেন স্বজনরা। অন্যদিকে বিভিন্ন জায়গায় স্থানীয় এমপিদের বিরুদ্ধে উঠেছে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগও। এদিকে শুরুতে এমপি-মন্ত্রীর স্বজন নিয়ে বিভ্রান্তি থাকলেও পরে বিষয়টি পরিষ্কার করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, নির্বাচন প্রভাবমুক্ত রাখতেই মন্ত্রী-এমপির পরিবারের সদস্যদের প্রার্থী না হওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। এ সময় পরিবার বলতে ‘নিজে (মন্ত্রী বা এমপি), তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েকে’ বুঝিয়েছেন বলেও ব্যাখ্যা দেন। তিনি বলেন, নির্বাচনকে প্রভাবমুক্ত রেখে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হোক। সেক্ষেত্রে যারাই জিতে আসে আসুক, মানুষ যাকে চাইবে সে-ই আসবে।